Theatre Movement

18/05/2009 13:18

 

মিডিয়াওয়াচ

মুভমেন্ট থিয়েটারের মুকিদ চৌধুরী

মানুষটি অঙ্কের লোক। কিন্ত তার ভেতরে কাজ করে মুভমেন্টের নানা বিষয়। নাচের নানা মুদ্রা আর চলনের সন্ধানে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। নাচের এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলেছেন মিডিয়াওয়াচ প্রতিনিধি সিডনী। কথা হয় নাচ আর নাটক নিয়ে। ঐত্যির সন্ধান আর আধুনিকায়নের আঙ্কিক নিয়ে নানা কথা। তার কথার মালা নিয়ে সাজানো এই বিশেষ প্রতিবেদন-

একজন মুকিদ চৌধুরী

তার জন্ম উত্তাল পূর্ব-পাকিস্তানে। দেশে গণ-আন্দোলনের ঢেউ শুরু হয়েছে। তারপর স্বাধীনতার কিছু পরেই বাবার সং্গে ইংল্যান্ডে চলে গেলেন। সেখানে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন এই মানুষটি। লেখাপড়া করেছেন অঙ্কশাস্ত্রে কিন্ত তার আগ্রহ নাচ। তাই এখনো দেশে এসেই নাট্যকর্মীদের সঙ্গে নাচ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান।

নাম তার ইস্ট-ওয়েস্ট ফিউশন

তিনি এগার বছর বয়স থেকে নাচের সঙ্গে যুক্ত। ব্যালে দেখতে ভালো লাগতো। বডির সর্বত্র একই ভাষা। ছোট বেলা থেকেই মানুষের চলন তাকে আকর্ষণ করে। তারপর থেকেই নাচের সঙ্গে ঘরসঙসার। লন্ডনে ওয়ের্স্টান কন্টেম্পরির উপর ডিপ্লোমা করেন। ভারতীয় নাচ নিয়ে তার আগ্রহ ছিলো। ভরত-নাট্যমের পর কত্থকের চলন থেকে ভারতীয় নাচের প্রতি আগ্রহ হয়। ব্যস, ভারতীয় বিদ্যাভবনের ইন্ডিয়ান আর্টস এন্ড কালচার ইন্সিটিউট থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ল্যাটিন নৃত্যধারা, সালসা নাচের উপর প্রশিক্ষণ নেন। তারপর টাঙ্গো নাচ, টাঙ্গো নাচটি আরো আকর্ষণীয়। এখানে দুজন নৃত্যশিল্পী নাচেন। তার ভালো লাগে সাম্বা নাচ, ব্রাজিল অঞ্চলের এ নাচটি মূলত যুদ্ধ নাচ। ছেলেরা এ নাচে অঙশ নেয়। তিনি লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাস্টিব্যাল অফ থিয়েটার বা লিফটের সঙ্গে কাজ করেন। এখানে সাউথ এশিয়া আর্ট ফোরাম গঠন করা বাঙলাদেশের কাজ দেখতে শুরু করেন। বাঙলা থেকেই নিজের চলন অনুসন্ধান করেন। লাঠিখেলা, ব্যালে, মণিপুরের মুদ্রা এবং যোগ-ব্যয়াম মিলে এই আঙ্গিক তৈরি হলো। নাম দিয়েছেন ইস্ট-ওয়েস্ট ফিউশন। ফিউশন করার পেছনে যে ভাবনাটি তার ভেতরে কাজ করে সেটি হলো বাংলাদেশে এসে প্রবাসী। তিনি বলেন, ইংল্যান্ডে গেলে আমাকে কেউ কেউ বলে ‘পাকি’। এটা আমার ভেতরে অন্যরকম একটা আঘাত করে। তখন স্বদেশ অনুসন্ধান করতে থাকি। আমার জন্মভূমি যেন কল্পনার জন্মভূমি। সেটা থেকেই এই ফিউশন, আমার ইমাজেনারী হোমল্যান্ডের ছবি।

আমার পথচলা

তিনি অনেকের সঙ্গে কাজ করেছেন। অলকানন্দ রায়, কুমুদিনী লাখিয়া, স্বাতস্বতী সেন, সুসমিতা ঘোষ, রাখা মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, টনি ফ্যাগান- এদের সঙ্গে কাজ করে প্রতিদিনই শিখেছেন। পশ্চিমবঙ্গের লোকদের সঙ্গে কাজ করে আনন্দ পেয়েছেন। গৌরী গুপ্ত, গৌতম গুপ্ত রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্ম জয়ন্তীতে মাসব্যাপী উৎসব করেছিলেন। তিনি বলেন, তখন আমার বয়স ১৩-১৪ হবে। সেসময় রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে নাচতাম। ১৯৮৫ সালে ‘চণ্ডালীকা’য় নেচেছি, অলকা নন্দ নাচ শিখিয়ে ছিলেন। আমার বাংলার শিক্ষক পুষ্পিতা চৌধুরী আমাকে অনেক উৎসাহ যোগিয়ে ছিলেন। তারপর তিনি ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘শাপমোচন’ দুটি অসাধারণ কাজ করেছেন। ‘চিত্রাঙ্গদা’ ঢাকাও করেছিলেন, লায়লা হাসানের সহযোগিতায় মহিলা সমিতির মঞ্চ অভিনীত হয়। নাহিদ সিদ্দকী তাকে ফিউশনের কাজ শিখিয়েছিলেন।

আমার ঐতিহ্য

তিনি বলেন, একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, বর্তমানে বাংলাদেশের পাহাড়ী/আদি অধিবাসীর নাচ অনেক বেশি বাংলার ঐতিহ্যের কাছাকাছি। সাঁওতাল নাচ তো আমাদেরই আদি সংস্কৃতির অংশ। আমরাই নিজেদের ঐতিহ্য মুছে ফেলতে চঞ্চল, তাই তো বঙ্গপুরি নৃত্য নিয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। মণিপুরি নাচ যে বাংলাদেশেরই নাচ সেকথাও বলতে চাই না। বাংলাকে ছোট করে দেখলে চলবে না। বাংলাঞ্চল ছিলো বিশাল। তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হচ্ছে বিশাল ও বিচিত্রধর্মী। সেখানেও আছে বাংলা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনেক কিছু। বর্তমানে মনিপুরি হচ্ছে পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ধ্রুপদী নাচ। মুরংদের নাচও আমাদেরই। তারা যখন নাচেন তখন পোশাকের বাহার থাকে না। কিন্ত আপনি যদি তাদের নাচ দেখেন তবে মনে হবে কোনো রকম অশ্লীলতা নেই। স্টেপিঙ খুবই সাধারণ, ধীর গতির মুভমেন্ট কিন্তু খুবই শক্তিশালী। তাই বলে কী চাকমা নাচ, ত্রিপুরার নাচ কিঙবা অহমীয়া নাচকে বাদ দেওয়া যায়! সবই তো আমাদের নাচের প্রবাহমানতার সঙ্গে যুক্ত।

ধ্রুপদীর পথে

বাঙলাদেশের মূলধারার যে নাচ তা লাঠিখেলা বা ইয়োগা। এই যোগগুলো মুভমেন্ট এর অংশ। রামকৃষ্ণ-যোগ, চৈতন্যদেবের-ধ্যান, লোকনাথ-যোগ, বুদ্ধ-যোগ এসবকে ভিত্তি করেই তৈরি করা যায় মুভমেন্ট। বাঙলার আদি চলন খুবই শক্তিশালী। এ-নিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের ধ্রুপদী শিল্পাঙ্গিক নেই তাই লাঠিখেলা বা ধামালিয়া নাচটি আমরা নিতে পারি। বাঙলাদেশের ছেলেরা লাঠিখেলা আর যোগ মিশিয়ে নাচবে। ছেলেদের নাচের এনার্জি আলাদা। নাচের ক্ষেত্রে নারী আর পুরুষেরর মুভমেন্ট আলাদা। আমি যখন ছেলেদের সঙ্গে কাজ করি তখন এই প্রশিক্ষণ একেবারেই অন্যরকম। আমাদের এখানে এ-ধরণের কাজ হচ্ছে না। ইমেজ ভাঙ্গার কাজটি কেউ করছে না। চলমান কাজটিকেই টেনে নিয়ে চলছেন। যেন বা একটি মৃতদেহকে টেনে নিয়ে চলা। বাঙলাদেশের নৃত্যশিল্পীরা এই মুভমেন্ট নিয়ে কাজ করবেন। হাটুডুডু, ফুটবল, ব্যাটমিন্টন, ক্রিকেট, নৌকা-বাইচেও মুভমেন্ট আছে। এটাও নাচের অংশ।

আগে কি সুন্দর দিন ছিলো

ফিউশন নিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালের আগে কেউ এ-ধরণের কাজ করেননি। উদয় শংকরের কাজ ছিলো অন্যরকম। মমতা শংকরের কাজও সেই ধারার। তবে পরবর্তী পর্যায়ে অনেকেই এই ধরণের কাজ করেছেন। তবে সুনির্দিষ্ট করে কারো নাম বলছি না। ১৯৯৭ সালের পর থেকেই ফিউশনের তরঙ্গ শুরু হলো। তবে সবাই যে শেষ পর্যন্ত কাজ করছেন তা নয়। এখন চলছে ভাটার সময়। নাইন ইলেভেন এবঙ জুলাই সেভেনের প্রভাব পড়েছে এখানে। কাজ করার জন্য যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন সে পরিমান টাকা সঙগ্রহ কঠিন হয়ে পড়েছে। নাইনটিজে প্রচুর নিরীক্ষামূলক কাজ হয়েছে সাউথ ইস্ট এশিয়ায়। গানের ক্ষেত্রে বালি সাগো, মেৌসুমী ভৌমিক ইস্ট-ওয়েস্টের মিলন মেলা নিয়ে কাজ করেছেন। এ.আর রহমান অন্য জিনিশ। নাচের ক্ষেত্রে শোভনা জয়সিঙ যে কাজ করছেন তা সত্যিই অসাধারণ। তবে আকরাম খানের কাজ দেখে মুগ্ধ না-হওয়ার কোনো কারণ নেই। শুনে আপনার ভালো লাগবে যে, আকরাম খান ঢাকার নবাবগঞ্জের ছেলে। আমি তাকে আমার অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। আকরাম খান এই ফিউশনকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। আমি কিন্তু এই ফিউশনকে পেশা হিসেবে নিতে পারিনি।

নির্মাণের স্রোতে

ফিউশন নিয়ে তার প্রডাকশনগুলো হলো- রং, দ্বিতীয় তরঙ্গ, রিদম ইন ওয়েভস, মাই ইমাজিনারী হোমল্যান্ড, মুনসুন, ক্যাওস, হিউম্যানিটি, রেইনবো, বাঁশির ডাক এবং উৎসব। ইউরোপ ছাড়াও বাঙলাদেশে তিনি কাজ করেছেন। বাংলাদেশে তিনি উপস্থান করেছেন- অনাহুত অতিথি (ঢাকা), নতুন দিগন্ত (ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ), বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ (সিলেট), এ ফিট উইদাউট রিদম (কুমিল্লা), সৃষ্টি (বিটিভি)। এছাড়াও রয়েছে চিত্রাঙ্গদা, তাসের দেশ, শ্যামা, চণ্ডালিকা, সাগরিকা, বর্ষাবরণ, বসন্ত উৎসব, শরৎ, রাজা, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি। এসব কাজ ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত চলে। রবীন্দ্র ও নজরুল কবিতা নিয়ে আরো কিছু কাজ করেন। এখানে বাঁশি কবিতা ও বিদ্রোহী কবিতার কথা না বললেই হয়। নিজেই এসবরে গ্রন্থণা ও নির্দেশনা দেন।

ওয়েভস ড্যান্স কোম্পানী

১৯৯৪ সাল থেকে সংস্কৃতর সঙ্গে যুক্ত আছেন। সবাই মিলে কিছু করার ভাবনা থেকে ওয়েভস ড্যান্স কোম্পানী। রিদম অফ দ্য ওয়েভস থেকেই এর নামটি নেওয়া হয়। সৃষ্টিশীল মানুষের মিলনমেলাই এ সংগঠন। একজন আরেকজনের প্রডাকশন কাভারেজ করেন। এভাবেই সঙগঠনটি একটি পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ওয়েভস ড্যান্স কোম্পানীর ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি আর্টিস্টিক ডিরেক্টর ছিলেন।

আমার থিয়েটার

থিয়েটার প্রসঙ্গে মুকিদ চৌধুরী বলেন, থিয়েটার আমার কাছে মুভমেন্টের অংশ। আমার প্রথম নাটক দুঃসময়। ১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ডে বন্যার পর নাটকটি তৈরি করি। এই নাটকে দেখানো হয়েছে বিপদ এলে মানুষের ভেতরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কি হয়? এখানে আরও একটি নাটক তৈরি করি নাম- রিফ্লেকশন অফ ফেস। স্বদেশে এবং কাল্পনিক ভূমি নিয়ে মনের ভেতর যে দ্বন্দ্ব সেটিই প্রধান হয়ে উঠে। এটাকে বলা যায় আমার আয়না। বাংলাদেশে এসে তৈরি করি ‘পুরান কথার শুকপাখী’। এই নাটকে কাজ করে নটরাজ, সৃজ্রমান, কণ্ঠশীলন, খোয়াই থিয়েটার। আমার বেশির ভাগ নাটকই কথা (কথক) আর মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এটাকে আপনি মেঘনাদবধ কাব্যের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। মেঘনাদবধ কাব্য আমার কাছে বিশাল নাটক। এর উপর বর্তমানে আমি কাজ করছি।

একজন সঞ্চালক বলেন

ভেতরের সৌন্দর্যকে তিনি বের করে আনতে চান। এ জটিল বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, সবার জন্যই শিল্প, তবে সৌন্দর্য প্রকাশের কাজ হয়ত সবার জন্য নয়। আমি বিশ্বাস করি, ছেলেমেয়েদের ভেতরে যে নাচ আছে তাকে বের করে আনা উচিত, এবং তারপর একে নান্দনিক বা সৌন্দর্যে বিকশিত বা প্রকাশিত করে মুভমেন্ট তৈরি করা। সে কারণেই আমি নির্দেশক নই, সঞ্চালক মাত্র। রাজা মহানন্দকে নিয়ে নতুন একটি প্রযোজনা তৈরি করছেন, এতে অংশগ্রহণ করছে সিলেটের একটি নাট্যদল। তারধারণা, আমরা নিজেদের মহৎ কাজ প্রায়ই ভুলে যাই, বা ভুলে থাকতে পছন্দ করি। নিজেদের প্রচারণার কাজ অন্য কেউ করে দেবে না। তাই বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আমাদেরই কাজ করতে হবে।

নিজেকে খুঁজি

কত্থক, ভারতনাট্যম- মনে হয় না বাঙালির নাচ। যেমন করে পাশ্চাত্ত্যের নাচগুলোও আমাদের নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার শিল্পাঙ্গিক নিয়ে আমাদের জানা আবশ্যক। আমাদের স্বরূপ অন্বেষণ করা উচিত। যারা এই সন্ধানে আছেন তারা একে নতুনতর জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। আমার কাছে যাত্রা একটি অসাধারণ থিয়েটার মুভমেন্ট। এর মেকআপ, পোশাক, সংলাপ আর চলন নিয়ে কাজ করা আরো বেশি উচিত। আমাদের মঞ্চ হওয়া উচিত এ্যরিনা টাইপ। চা-বাগানের নাচঘরের মতো গোল হবে আমাদের মিলনায়তন।

Back